বিনোদন ডেস্ক :
আজ শুক্রবার জনপ্রিয় অভিনেতা সালমান শাহর ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৬ সালের এই দিনে তিনি মারা যান। তবে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন বলে এটি মানতে নারাজ তার মা নীলা চৌধুরী। তার দাবি— তার ছেলে আত্মহত্যা করেনি, আত্মহত্যার কোনো আলামত নেই। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
ঢালিউড অভিনেতা ও মডেল ছিলেন সালমান শাহ। তাকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম প্রতিভাবান, জনপ্রিয়, সফল এবং কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার প্রকৃত নাম ছিল চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন। গণমাধ্যমে তাকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের রাজপুত্র, নায়কদের নায়ক, আধুনিক ঢালিউডের প্রথম সুপারস্টার, অমর মহানায়ক এবং স্বপ্নের নায়ক উপাধিতে ব্যক্ত করা হয়।
টেলিভিশন নাটক দিয়ে তার অভিনয়জীবন শুরু হলেও ১৯৯০-এর দশকে তিনি চলচ্চিত্রে অন্যতম জননন্দিত শিল্পী হয়ে উঠেন। ১৯৯৩ সালে তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত কেয়ামত থেকে কেয়ামত মুক্তি পায়। একই ছবিতে নায়িকা মৌসুমী ও গায়ক আগুনের অভিষেক হয়। সাড়ে তিন বছরের মতো স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে তিনি ২৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, যার অধিকাংশই ছিল ব্যবসাসফল। জনপ্রিয় এ নায়ক নব্বইয়ের দশকের বাংলাদেশে সাড়া জাগানো অনেক চলচ্চিত্র যেমন— বিক্ষোভ, সুজন সখি, কন্যাদান, স্বপ্নের ঠিকানা, মায়ের অধিকার, এই ঘর এই সংসার, সত্যের মৃত্যু নেই, আনন্দ অশ্রু ইত্যাদিতে অভিনয় করার মাধ্যমে দেশের শীর্ষ তারকায় পরিণত হন। তিনি পারিবারিক গল্প, কমেডি, সামাজিক ও রাজনৈতিক গল্প, অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র, গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত গল্প, আসন্ন যুগের গল্প, রোমান্স এবং ট্র্যাজেডির মতো বিভিন্ন ঘরানার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তাকে একাধারে প্রভৃতি প্রকৃতির চলচ্চিত্রে দেখা যেত যেখানে তিনি নিজের বহুমুখী অভিনয় প্রতিভা, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও বিভিন্ন ধরনের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে নিজের সক্ষমতার পরিচয় দেন। ফলস্বরূপ ব্যবসায়িক সাফল্য ও সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করেন এবং ঢালিউডে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক নেওয়া অভিনেতায় পরিণত হন। তার তিনটি চলচ্চিত্র স্বপ্নের ঠিকানা, সত্যের মৃত্যু নেই এবং কেয়ামত থেকে কেয়ামত ঢালিউড বক্স অফিসে সর্বকালের শীর্ষ দশটি সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে। তিনি সর্বস্তরের জনগণের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা ও ফ্যাশন সেন্সের জন্য বিখ্যাত হন। গণমাধ্যমে তাকে বাংলাদেশের সেরা ফ্যাশন আইকন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। চলচ্চিত্র বিশ্লেষকরা অর্থপূর্ণ সিনেমার একটি নতুন ব্র্যান্ড প্রবর্তন এবং আধুনিক যুগের নায়কদের অনুপ্রাণিত করার জন্য সালমান এবং তার শৈল্পিকতা ও ফ্যাশনকে কৃতিত্ব দেন।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইস্কাটনের বাসা থেকে চিত্রনায়ক সালমান শাহর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই সময় প্রথমে অপমৃত্যুর মামলা করেন সালমান শাহর বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। পরে ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই অভিযোগটি হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদন করা হয়। এ বিষয়ে তদন্ত করতে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা সিআইডিকে নির্দেশ দেন আদালত। তদন্ত শেষে ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সিআইডি। প্রতিবেদনে এ ঘটনাকে আত্মহত্যা বলা হয়। পরে ওই বছরের ২৫ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন গৃহীত হয়। তবে প্রতিবেদনটি প্রত্যাখ্যান করে রিভিশন মামলা করেন কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। পরে ২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠান আদালত। দীর্ঘ ১১ বছর পর ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট আদালতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক। ওই প্রতিবেদনেও সালমান শাহর মৃত্যুকে অপমৃত্যু বলা হয়। কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর ছেলে হত্যা মামলার বাদী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন মা নীলা চৌধুরী। ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজির আবেদন করেন। সর্বশেষ মামলাটি পিবিআই তদন্ত করে। ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর আদালত ওই প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলাটি নিষ্পত্তি করেন। ২০২২ সালের ১২ জুন এই আদেশের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলা দায়ের হয়। আগামী ২ জানুয়ারি রিভিশন মামলার বিষয়ে শুনানি হবে।
এদিকে লন্ডন থেকে টেলিফোনে সালমান শাহর না নীলা চৌধুরী বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন সালমান শাহ হত্যার বিচার হবে, আমি এটার বিচার করব। কিন্তু তিনি করলেন কোথায়? আমি জানতাম শেখ হাসিনার আমলে বিচার হবে না। আমরা শেখ হাসিনা সরকারের পরিবর্তন চেয়েছিলাম। নতুন প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে ওই সরকারের বিদায় দরকার ছিল। অবশেষে তাদের বিদায় হয়েছে। আমরা নতুন সরকারের কাছে শুধু সালমান শাহ হত্যার বিচার না, সাগর-রুনি হত্যার বিচার চাই।’
তিনি বলেন, ‘দেশের ১৮ কোটি মানুষের চাওয়া সালমান শাহ হত্যা মামলার বিচার হোক। হত্যার পেছনে তার স্ত্রী সামিরা, আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ফিল্মের অনেকে রয়েছে। সালমান শাহর জন্য ৪১ জন ভক্ত-অনুরাগী মারা গেছে। আমি মা তো মরতে পারলাম না। আমি যদি মরেও যাই, ভক্ত-অনুরাগীরা এ মামলার বিচার চালিয়ে নেবে।’
অভিযোগ করে নীলা চৌধুরী বলেন, ‘বনজ কুমার অনেক টাকা খেয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন। আমাদের কাছে বারবার টাকা চাওয়া হয়েছে। সালমান শাহর অডিও রেকর্ডের ক্যাসেট পিবিআইতে দিয়েছিলাম, কিন্তু সেটা ফেরত পাইনি। এ মামলার বিচার চাইতে গিয়ে আইনমন্ত্রী, পিপি আব্দুল্লাহ আবু, আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আমাকে অনেক হেনস্তা করেছে। আব্দুল্লাহ আবু রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হয়েও তিনি সালমান শাহ হত্যা মামলার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফিরব। এখন দেশে গেলে আমার নিরাপত্তা নেই। ২০১৮ সালে ফোনে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সালমান শাহর মা হওয়ায় আমাকে নিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে। পরে দেশ ছেড়ে এখানে (লন্ডনে) আশ্রয় নিয়েছি।’
এ বিষয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, আগামী ২ জানুয়ারি রিভিশন মামলার বিষয়ে শুনানি হবে। আমরা সঠিক তদন্তের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাব। যাতে প্রকৃত আসামিরা আইনের আওতায় আসে। এ হত্যার বিচার যেন সালমান শাহর মা দেখে যেতে পারেন, সেটাই প্রত্যাশা করি।